রোমানিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি শহর তিমিসোরা। রোমানিয়ান, হাঙ্গেরিয়ান এবং জার্মানরা এই শহরে বসবাস করছে শতাব্দীর পর শতাব্দী কাল ধরে।
একসাথে হয়ে ১৯৮৯ সালে বিপ্লব শুরু করেছিলেন তারা যাতে পতন ঘটেছিল কমিউনিস্ট একনায়ক নিকোলাই চসেস্কুর।
এখনও এই শহর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লোকজনকে স্বাগত জানাচ্ছে, অন্তত তাদেরকে সহ্য করে নিচ্ছে। এরা আফগান, পাকিস্তানি, কুর্দি কিম্বা সিরিয়ান নাগরিক।
তাদের সবারই গন্তব্য পশ্চিম ইউরোপ।
দীর্ঘ পথ চলতে গিয়ে মাঝে কয়েকদিনের জন্যে শুধু আশ্রয় নেওয়া এই তিমিসোরা শহরে।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই শহরের স্থানীয় লোকজনের আতিথেয়তায় ও আচরণে মুগ্ধ হয়ে তিমিসোরার প্রেমে পড়ে গেছেন এবং এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবে পশ্চিম ইউরোপে এসব অভিবাসন প্রত্যাশীদের বেশিরভাগই তাদের জীবন সঁপে দিয়েছেন পাচারকারীদের হাতে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে এখান থেকেই ১৮ জনের একটি দল যাত্রা শুরু করেছিল পশ্চিম ইউরোপ অভিমুখে। যাত্রাপথে তাদের একজন নারী, যিনি দুটো যমজ বাচ্চার মা এবং পাচারকারী ব্যক্তি এই দু’জন মারা গেছেন।
স্থানীয় একজন পাচারকারীর নেতৃত্বে তারা যাত্রা শুরু করেন ২০১৭ সালের ১লা অক্টোবর। তাদের গন্তব্য জার্মানি অথবা ইতালি। কিন্তু প্রথমে সীমান্ত পার হয়ে পৌঁছাতে হবে হাঙ্গেরি।
তাদের কেউ কেউ কুর্দিস্তানে থাকতেই একে অপরকে চিনতেন। বাকিরা তিমিসোরা শহরে এসে অন্যদের সাথে পরিচিত হয়েছেন।
রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তারা হাঁটতে শুরু করেন। টানা দুই রাত ধরে তারা হাঁটতে থাকেন। দিনের বেলায় তারা লম্বা লম্বা ভুট্টা ক্ষেতের ভেতরে লুকিয়ে থাকতেন। আবার হাঁটা শুরু করতেন অন্ধকার নেমে এলেই।
তাদেরই একজন আইদি বলেন, “খুব ঠাণ্ডা ছিল সেসময়।” সাফা নামের আরেকজন বলেন, “শিশু আর নারীদের অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ।”
তৃতীয় দিন রাতের বেলায়, রাত ঠিক দুটোর দিকে, তিউনিসিয়ার একজন পাচারকারী একটি কালো ভ্যান গাড়িতে তাদের তুলে নিয়ে যায়।
ওই ভ্যানের প্লেট নম্বরটি ছিল ইতালির। তারপর তারা যাত্রা শুরু করেন সীমান্তের দিকে।
মুরাত নামের একজন বলেন, “আমার ধারণা হাঙ্গেরির পুলিশ ইতোমধ্যেই আমাদের অনুসরণ করতে শুরু করে। কারণ তারা খুব দ্রুতই আমাদের পেছনে এসে ধাওয়া করতে শুরু করলো।”
পাচারকারী চালক যখন তার গাড়ির আয়নায় নীল আলোর ফ্ল্যাশ দেখতে পেলো – তখন সে চিৎকার করে তার যাত্রীদেরকে গাড়ির ভেতর থেকে নেমে যেতে বললো। চালক তখন অসম্ভব দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে শুরু করলো।
তখনই গাড়িটি গিয়ে ধাক্কা খেলো পুলিশের একটি রোডব্লকের সাথে। সেখানেই প্রাণ হারালেন ন’বছর বয়সী দুটো যমজ বাচ্চার মা, বারান। আর পাচারকারী চালক মারা গেলেন পরদিন।
যে ১৭ জন প্রাণে বেঁচে গেলেন তাদেরকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হলো। তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল হালি নামের এক ইরাকি নারীর।
তার হাত ও পা-সহ শরীরের বিভিন্ন জায়গার হাড় এমনভাবে ভেঙে গিয়েছিল যে তিনি উঠেও বসতে পারতেন না।
তার স্বামী ইরাকে। এক ছেলে জার্মানিতে। ওখান থেকেই তারা পাঠিয়েছে চিকিৎসার খরচ।
হালির এক ছেলে সাফা আছেন তার সাথে। হাসপাতালের কাছেই অল্প খরচে একটা থাকার জায়গা ভাড়া করেছেন তারা। চিকিৎসার বিল ইতোমধ্যেই ১০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। হাতে আর কোন টাকা পয়সা নেই তাদের।
সাফা বলেছেন, হাঙ্গেরির সরকার নতুন যে আইন পাস করেছে সেখানে অভিবাসী এবং অভিবাসীদেরকে কেউ সাহায্য সহযোগিতা করলে তাকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও হাসপাতালে তারা যে চিকিৎসা পেয়েছেন তাতে তারা খুশি। তবে তাদের সাথে হাঙ্গেরির পুলিশের আচরণে তারা খুশি হতে পারেন নি।
তারা জানান, সবসময় ওয়ার্ডে পুলিশের উপস্থিতি ছিল। তারা সুস্থ হয়ে গেছে এরকম কাগজপত্রে সই দেওয়ার জন্যে ডাক্তারদেরকে তারা অনেক চাপ দিয়েছে, যাতে তাদেরকে অচিরেই রোমানিয়ায় ফেরত পাঠানো যায়।
একসময় সবাইকে তিমিসোরায় ফেরত পাঠানো হলো। এতিম ওই দুই যমজ শিশু রয়ে গেল হাঙ্গেরিতে। তাদের সাথে ছিল ১২ বছর বয়সী আরো একটি মেয়ে-শিশু। সে একাই ছিল ওই দলে। গুরুতর আহত হওয়ার কারণে হালিকেও ফেরত পাঠানো হয়নি। তার দুই শিশুও রয়ে গেল তার সাথে, হাঙ্গেরিতে।
কিন্তু এখানেই যাত্রা শেষ হয়নি বাকিদের। তাদের একজন আখির খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লরিতে করে পৌঁছে গেছেন জার্মানিতে। এজন্যে তার সময় লেগেছে ৩৭ ঘণ্টা। আশ্রয় চেয়ে জার্মান সরকারের কাছে তিনি আবেদনও করেছেন।
আরো তিনজন গত মে মাসে এসে পৌঁছেছেন জার্মানির হানোফার শহরে। তার আগে তাদেরকে চেক প্রজাতন্ত্রের একটি বন্দী শিবিরে দু’মাস কাটাতে হয়েছে।
তারা আসছিলেন একটি লরিতে করে। ধরা পড়লে তাদেরকে ওই শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়।
তিমিসোরায় গুজব হচ্ছে এরকম যাত্রার জন্যে পাচারকারীকে দিতে হয় দু’হাজার ডলার আর সীমান্ত রক্ষীদের আরো এক হাজার ডলার। হাঙ্গেরির পুলিশ অবশ্য এরকম অভিযোগ স্বীকার করেনি।
আইদি, যিনি জার্মানির একটি অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে দিন কাটাচ্ছেন, তিনি বলেন, ভয় তাকে এতোটা তাড়া করেছিল যে তার মনে হয়েছিল পুলিশ তাকে এখানেও এসে খুঁজে বের করবে।
ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে সামির গত এপ্রিল মাসে চলে গেছেন ইতালি। দুই যমজ কন্যাকে দত্তক নিয়েছে জার্মানিতে তাদেরই কিছু আত্মীয় স্বজন। হুরিয়াকে নিয়েছেন ভিয়েনাতে তার এক খালা।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার মধ্যস্থতায় সাফা এবং হালিকে রাখা হয়েছে হাঙ্গেরির একটি আশ্রয় কেন্দ্রে। পরিবারের সাথে একত্রিত হওয়ার জন্যে তাদের আবেদন জার্মান সরকার অনুমোদনও করেছে।
বাকিদের সাথেও যোগাযোগ করে জানা গেছে যে তারা এখন জার্মানিতে। ওমর নামের একজনকে জার্মানি থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রোমানিয়ায়।
দুর্ঘটনার প্রায় ন’মাস পর প্রাণে বেঁচে যাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ১৪ জনই পশ্চিম ইউরোপে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু দুর্ঘটনার ভয়াল সেই স্মৃতি তাদেরকেও এখনও তাড়া করছে।
রাজনীতিকরা যতোই দাবি করুক না কেন যে অভিবাসীদের ইউরোপে আসার পথ বলকান রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তারপরেও এই পথে লোকজনের আসা অব্যাহত রয়েছে।
সূত্র, বিবিসি